Menu

More

Monday, December 23, 2024
Light
Dark

ভারতে এবার বাংলাদেশের ক্রিকেট সিরিজে কেন এত নিরাপত্তার কড়াকড়ি?

গত শতাব্দীর আশি বা নব্বইয়ের দশকে যখন পাকিস্তান ক্রিকেট দল ভারতে নিয়মিত সিরিজ বা কোনও টুর্নামেন্ট খেলতে আসত, এই ধরনের দৃশ্য তখন হামেশাই চোখে পড়ত।

স্টেডিয়ামের বাইরে ও ভেতরে তখন গিজগিজ করত পুলিশ, মাঠে ঢোকার ক্ষেত্রে থাকত হাজারো কড়াকড়ি। বিভিন্ন উগ্র হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী মাঠে হাঙ্গামা বাঁধানোর চেষ্টা করতে পারে, এই আশঙ্কায় তটস্থ থাকতে হত ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তা ও নিরাপত্তাকর্মীদের।

’৯১ সালে মহারাষ্ট্রের শিবসেনা দলের কর্মীরা তো একবার মুম্বাইয়ের বিখ্যাত ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের পিচ খুঁড়ে দিয়ে ভারত-পাকিস্তানের ম্যাচই ভন্ডুল করে দিয়েছিলেন। ‘সন্ত্রাসবাদে মদতদাতা’ পাকিস্তানের সঙ্গে কোনও খেলা নয় – এটাই ছিল তখন শিবসেনার ঘোষিত নীতি।

সেই ঘটনার তেত্রিশ বছর বাদে আজও ভারতের কোনও মাঠে আন্তর্জাতিক ম্যাচের আগে ম্যাচ ভেস্তে দেওয়ার চেষ্টা আটকাতে প্রশাসনকে বিরাট কড়াকড়ি আরোপ করতে হবে, হাজারে হাজারে পুলিশ মোতায়েন হবে বা কালো পতাকা নিয়ে মাঠে ঢুকতে বাধা দিতে হবে – এ জিনিস কিন্তু প্রায় অকল্পনীয় ছিল।

অথচ গত রবিবার (৬ অক্টোবর) গোয়ালিয়রে ভারত বনাম বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচটির আগে অবিকল সেই দৃশ্যই দেখা গেছে।

ওই ম্যাচের মাধ্যমেই দীর্ঘ ১৪ বছর পর শহরে ফিরেছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট – অথচ ম্যাচ যাতে নির্বিঘ্নে হতে পারে সে জন্য পুরো গোয়ালিয়রকে মুড়ে ফেলা হয়েছিল কড়া নিরাপত্তার চাদরে, শহরের নতুন স্টেডিয়াম নিয়েছিল প্রায় দুর্ভেদ্য দুর্গের চেহারা।

গোয়ালিয়রে কালো পতাকা, কোটলায় কী?

তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যখন টিম বাসে হোটেল থেকে মাঠে যাচ্ছে, শহরের এক প্রান্তে পুলিশের নজর এড়িয়ে ‘বজরং দল’-এর কিছু কর্মী তাদের কালো পতাকাও দেখিয়ে ফেলেন!

তারও আগে শুক্রবার বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা জুম্মার নামাজ পড়তে মসজিদেও যেতে পারেননি, হোটেলেই তাদের নামাজ আদায় করতে হয়েছে।

অথচ গোয়ালিয়রের ফুলবাগ এলাকায় বিখ্যাত মোতি মসজিদ ছিল তাদের হোটেল থেকে মাত্রই তিন কিলোমিটার দূরে – কিন্তু নিরাপত্তার কারণেই তাদের সেখানে যেতে নিষেধ করা হয়েছিল।

সেই টি-টোয়েন্টি সিরিজেরই দ্বিতীয় ম্যাচ আজ বুধবার (৯ অক্টোবর) রাজধানী দিল্লির অরুণ জেটলি ক্রিকেট স্টেডিয়ামে, যে মাঠটি ‘ফিরোজ শাহ কোটলা’ নামেই বেশি পরিচিত।

গোয়ালিয়রের শ্রীমন্ত মাধবরাও সিন্ধিয়া স্টেডিয়াম তবু ছিল মূল শহরের একটু বাইরে, আর ‘কোটলা’ হল দিল্লির একেবারে কেন্দ্রস্থলে।

স্টেডিয়ামে আসার জন্য মেট্রো রেল-সহ গণপরিবহনও খুবই ভাল। ফলে ম্যাচের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আজ দিল্লি পুলিশের দুশ্চিন্তাও কম নয়।

চলতি সিরিজের প্রথম পর্বে বাংলাদেশ যখন চেন্নাই ও কানপুরে পরপর দুটি টেস্ট খেলে, সেখানেও ম্যাচের নিরাপত্তা নিয়ে আয়োজকদের একই রকম সমস্যায় পড়তে হয়েছিল।

ওই দু’টি ভেন্যুতেও ছিল ম্যাচ ভন্ডুল করে দেওয়ার হুমকি – যদিও বিসিসিআই শেষ পর্যন্ত নির্বিঘ্নেই টেস্ট দুটো শেষ করতে পেরেছে।

বাংলাদেশ জাতীয় দল ভারতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সিরিজ খেলতে আসছে সেই ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে, যেবার তারা হায়দ্রাবাদে ভারতের মাটিতে ভারতের বিরুদ্ধে প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলে। তার আগে ও পরে ভারতে তারা বহুবার এশিয়া কাপ, বিশ্বকাপেও খেলে গেছে।

কিন্তু এত বছরের মধ্যে ভারতে বাংলাদেশের ম্যাচ নিয়ে কর্তৃপক্ষকে কখনওই এমন দুশ্চিন্তায় পড়তে হয়নি – যেটা এবারে হচ্ছে।

আর একটু অদ্ভুত শোনালেও বাস্তবতা হল, এর সঙ্গে কিছুটা সম্পর্ক আছে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পালাবদলের!

‘হিন্দু নির্যাতনকারীদের সঙ্গে ক্রিকেট নয়’

আসলে গত ৫ই অগাস্ট বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের বিদায়ের পর থেকেই যেভাবে সে দেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর হামলা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে, তাতে সে দেশের সঙ্গে ভারতের ক্রিকেট খেলাও বর্জন করা উচিত বলে দাবি তুলেছে এ দেশের বেশ কিছু হিন্দুত্ববাদী সংগঠন।

বাংলাদেশ দল যে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে দুই টেস্ট ও তিনটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচের সিরিজ খেলতে ভারতে আসবে, এটা অবশ্য বহু আগে থেকেই নির্ধারিত হয়ে ছিল।

কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারতের উচিত এই সিরিজ বয়কট করা – এমন দাবিতে সরব হয় বেশ কিছু সংগঠন, ক্রিকেট বোর্ডের কাছেও এই মর্মে স্মারকলিপি জমা পড়তে থাকে।

১৯শে সেপ্টেম্বর চেন্নাইতে শুরু হয় সিরিজের প্রথম টেস্ট। তার আগে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকেই ভারতে সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ড করতে থাকে ‘হ্যাশট্যাগ বয়কটবাংলাদেশক্রিকেট’।

হিন্দু মহাসভা, বজরং দল, হিন্দু জনজাগৃতি সমিতি-র মতো এদেশের বেশ কিছু হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বলতে শুরু করে, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত যদি ক্রিকেট খেলে, তাহলে হিন্দুদের ধর্মীয় ভাবাবেগেই আঘাত করা হবে।

ভারত ও ভারতের বাইরে বেশ কয়েকজন দক্ষিণপন্থী সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারও এই দাবিকে সমর্থন জানান। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিক্রম প্রতাপ সিং, অভয় নারায়ণ কুলকার্নি প্রমুখ।

চেন্নাই টেস্টের আগে ওই ম্যাচ বাতিল করার দাবি জানিয়ে গোয়ার হিন্দু জনজাগৃতি সমিতি বিবৃতি দেয়, “বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫২টিতেই হিন্দুরা আক্রান্ত। এই পরিস্থিতিতে ভারত যদি বাংলাদেশের সঙ্গে ক্রিকেট খেলে তার চেয়ে কলঙ্ক ও অমর্যাদার আর কী হতে পারে?”

এই ম্যাচ খেলা হলে তা বাংলাদেশের হিন্দুদের ‘ব্যথার ক্ষতস্থানে আরও খুঁচিয়ে ঘা করা হবে’ বলেও তারা মন্তব্য করে।

গোয়ালিয়রে হিন্দু মহাসভার প্রেসিডেন্ট জয়বীর ভরদ্বাজ আবার তার শহরে ম্যাচ বাতিল করার দাবি জানিয়ে সোজা চিঠি লেখেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *