রক্তের রোগ থ্যালাসেমিয়ার বাহকের হার যে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের চেয়ে বাংলাদেশে বেশি তা হয়তো আমাদের অনেকেরই জানা নেই।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সম্প্রতি প্রকাশিত জাতীয় থ্যালাসেমিয়া জরিপ– ২০২৪ এর হিসেব অনুযায়ী দেশটির জনসংখ্যার মধ্যে ১১.৪% মানুষ থ্যালাসেমিয়ার বাহক।
বিশ্বের অন্য অনেক দেশ বা অঞ্চলের তুলনায় বাংলাদেশের জনসংখ্যার মধ্যে থ্যালাসেমিয়া বাহকের এই হার তুলনামূলকভাবে বেশি।
ইউরোপিয়ান জার্নাল অব হেমাটোলজিতে প্রকাশিত ২০২০ সালের এক গবেষণাপত্রে উঠে আসে যে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে থ্যালাসেমিয়া বাহকের হার সবচেয়ে বেশি।
ঐ গবেষণাপত্রের হিসেব অনুযায়ী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় থ্যালাসেমিয়া বাহকের হার সবচেয়ে বেশি মালয়েশিয়ায়, ১২.৮%।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে মিশরে এই হার সবচেয়ে বেশি, ৯-১০%।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন অঞ্চলগত বা জাতিগত বিশেষত্বের কারণে বিশেষ এলাকার মানুষের মধ্যে থ্যালাসেমিয়ার হার বেশি হয়ে থাকে।
“থ্যালাসেমিয়া শব্দটির উৎপত্তি গ্রীক শব্দ ‘থ্যালাসা’ থেকে, যার অর্থ সমুদ্র। একসময় ধারণা করা হতো শুধু সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষেরই থ্যালাসেমিয়া হয়। ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার দেশগুলোর মানুষের মধ্যে এই রোগের হার সবচেয়ে বেশি ছিল,” বলছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক গুলজার হোসেন।
তিনি বলছিলেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যার মধ্যে থ্যালাসেমিয়া বাহকের হার কী পরিমাণ, তা নির্ণয়ে জাতীয় পর্যায়ে কোনো জরিপ হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় হওয়া কয়েকটি জরিপের বরাত দিয়ে তিনি ধারণা প্রকাশ করেন যে বাংলাদেশে মানুষের মধ্যে থ্যালাসেমিয়া বাহকের হার প্রায় ১৪% হয়ে থাকতে পারে।
তবে থ্যালাসেমিয়া বাহক মানেই কিন্তু থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগী নন।
তাহলে থ্যালাসেমিয়া বাহক আসলে কারা? থ্যালাসেমিয়া রোগীর সাথে তাদের পার্থক্য কী? থ্যালাসেমিয়া রোগটি সম্পর্কেই বা কী জানা যায়?
থ্যালাসেমিয়া কী?
থ্যলাসেমিয়া রক্তের এক ধরনের রোগ। জিনগত পরিবর্তনের ফলে রক্তের হিমোগ্লোবিন উৎপাদনে অস্বাভাবিকতা তৈরি হয়ে মানুষ থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে।
এই রোগ হলে রক্তে হিমোগ্লোবিন উৎপাদন প্রয়োজনের চেয়ে কম পরিমাণে হয় বা একেবারেই হয় না।
এই হিমোগ্লোবিন ব্যবহার করে লোহিত রক্ত কণিকা দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে অক্সিজেন সরবরাহ করে।
শরীরের ভেতরে অক্সিজেন চলাচল কম হওয়ায় থ্যালাসেমিয়া আক্রান্তরা শারীরিকভাবে দুর্বল বোধ করে, তাদের ত্বক ফ্যাকাসে দেখায় ও তাদের শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হয়।
এছাড়া অরুচি, জন্ডিস, বারবার সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়া, পেট ব্যথা, শারীরিক বৃদ্ধিতে ধীরগতির মতো উপসর্গও দেখা যায় থ্যালাসেমিয়া হলে।
বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনের হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বছর সাত হাজার শিশু জন্ম নেয় থ্যালাসেমিয়া নিয়ে। এই শিশুদের মধ্যে থ্যালাসেমিয়ার উপসর্গ দেখা দেয় জন্মের এক থেকে তিন বছরের মধ্যে।
থ্যালাসেমিয়া কেন হয়?
থ্যালাসেমিয়া হওয়ার কারণ ত্রুটিপূর্ণ জিন, যা রক্তে হিমোগ্লোবিন উৎপাদনকে প্রভাবিত করে।
এটি একটি জন্মগত রোগ। অর্থাৎ, একজন শিশু জন্মের সময়ই থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত হয়ে থাকে।
হেমাটোলজি বিশেষজ্ঞ ডা. গুলজার হোসেন বলছিলেন, “দুই জন থ্যালাসেমিয়া বাহক যদি চারটি সন্তান জন্ম দেন, তাহলে তাদের মধ্যে একজনের থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অর্থাৎ ২৫% সম্ভাবনা থাকে যে একজন সন্তান থ্যালাসেমিয়া রোগী হিসেবে জন্ম নিবে।”
অর্থাৎ, থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশু যেই ত্রুটিপূর্ণ জিন নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে, ঐ শিশুর বাবা ও মা’র মধ্যে আগে থেকে সেই ত্রুটিপূর্ণ জিনের উপস্থিতি ছিল।
এরকম ক্ষেত্রে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুর বাবা-মা’কে থ্যালাসেমিয়া বাহক বলা হয়।
থ্যালাসেমিয়া বাহক কারা?
ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবাদানকারী সংস্থা ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের তথ্য অনুযাীয় থ্যালাসেমিয়া বাহক যে কেউ হতে পারেন।
থ্যালাসেমিয়া বাহকরা ত্রুটিপূর্ণ জিন বহন করলেও তারা নিজেরা কখনোই থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত হন না।