বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন নিজেই দেখেছেন যে সেখানে গত বছর অক্টোবর মাসে এক দিনেই একাত্তর জন রোগীর এন্ডোসকপি করেছেন একজন চিকিৎসক।
মি. সেন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন তিনি ওই হাসপাতালকে রোগীর সংখ্যার চেয়ে মানসম্পন্ন চিকিৎসার পরামর্শের পাশাপাশি এসব ক্ষেত্রে পরিবর্তনের জন্য একটি সময় বেঁধে দিয়ে এসেছেন।
“আমরা ওদের সময় দিয়েছি। আশা করি তারা ঠিক করে ফেলবে। তাদের বলেছি রোগনির্ণয় বা এন্ডোসকপিসহ চিকিৎসার ক্ষেত্রে যত্নবান হতে হবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
ঘটনাটি হয়েছে ঢাকার সুপরিচিত বেসরকারি হাসপাতাল ল্যাবএইডে।
ওই হাসপাতালের কর্ণধার অবশ্য বিবিসি বাংলাকে বলছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পরিদর্শনের সময় তিনিও সাথে ছিলেন। তার দাবি ঘটনাটি যেভাবে প্রচার হচ্ছে আসলে তা নয়। “আমরা চেষ্টা করছি রোগীদের কম টাকায় সর্বোচ্চ সেবা দিতে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চিকিৎসকরা যেসব প্রটোকল অনুসরণ করেন সেটাও করা হচ্ছে,” বলছিলেন তিনি।
তবে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বিবিসিকে বলেছেন একদিনে ৭১টি এন্ডোসকপি তার নেতৃত্বে হয়নি। “আমি সহ আরও অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সেখানে কাজ করেন। সবাই মিলে একাত্তরটি হতে পারে। আর ওই হাসপাতালের এন্ডোসকপি বিভাগের প্রধান আমি নই, ফলে আমার নেতৃত্বে এতো এন্ডোসকপি হওয়ার সুযোগই নেই,” বলছিলেন তিনি।
যদিও স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে হাসপাতালগুলোতে রোগী দেখার সময় কতটা হবে কিংবা রোগ নির্ণয়ের বিভিন্ন পরীক্ষার ক্ষেত্রে কী কী নিয়ম অনুসরণ করতে হবে তার কোন বিধিমালা না থাকায় তারা এসব বিষয়ে ‘চিকিৎসকের বিবেকের’ ওপর নির্ভর করছেন।
একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলছেন হাসপাতালগুলোতে মানসম্মত সেবা বা কোয়ালিটি কন্ট্রোল নিশ্চিত করার জন্য রোগী ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বাইরে তৃতীয় কোন সংস্থা (রেগুলেটরি) থাকা জরুরি হয়ে পড়েছে।
৭১ এন্ডোসকপির ঘটনা আসলে কী ও সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন
স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন বৃহস্পতিবার ঢাকার দুটি হাসপাতাল পরিদর্শন করেন এবং এর একটি হচ্ছে ল্যাব এইড হাসপাতাল। সেখানে নথিপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায় গত বছরের অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে এক দিনে একাত্তরটি এন্ডোসকপি হয়েছে।
এন্ডোসকপি হচ্ছে এক ধরনের পরীক্ষা যার মাধ্যমে একজন চিকিৎসক রোগীর শরীরের ভেতরে কোনও অংশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। এন্ডোসকপি শরীরের বিভিন্ন অংশে হতে পারে। এক্ষেত্রে একটি নমনীয় টিউবের মাথায় ক্যামেরা লাগিয়ে রোগীর শরীরে প্রবেশ করানো হয়। খাদ্যনালী এবং পাকস্থলীতে সমস্যা নির্ণয়ের জন্য রোগীর মুখ দিয়ে এই নল প্রবেশ করানো হয়।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পরিদর্শনের পর স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে খবর আসে যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীলের নেতৃত্বেই ওই একাত্তরটি এন্ডোসকপি হয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন ঘটনাটি হাসপাতালে হয়েছে বলে তিনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে রোগীর সংখ্যা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব কম দিয়ে মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার পরিচালক ডাঃ আবু হোসেইন মোঃ মঈনুল আহসান বলছেন তাদের ঘটনাটি এক দিনের হওয়াতে আলোচনা হচ্ছে, তবে এন্ডোসকপির সংখ্যা এখন গড়ে কমে এসেছে।
“এক দিনে কতটা এন্ডোসকপি করা যাবে বা কত রোগী দেখা যাবে তা নিয়ে কোন বিধিমালা নেই। তবে যারা এগুলো করেন তারা রেজিস্টার্ড ডাক্তার। আমরা তাদের বিবেচনা বোধের ওপর নির্ভর করি। আমাদের আস্থাও আছে। তাছাড়া হাসপাতালগুলোও আমরা নিয়মিত পরিদর্শন করি। আবার প্রতি বছর লাইসেন্স নবায়নের সময়ও আমাদের টীম পরিদর্শন করে যে যথাযথ সুবিধা ও উপকরণ মেনে কাজ হচ্ছে কি-না,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
চিকিৎসক কী বলছেন
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল অবশ্য বিবিসি বাংলাকে বলেছেন যে একাত্তর এন্ডোসকপি তার নেতৃত্বে হয়নি।
“আমি ল্যাব এইডের এন্ডোসকপির প্রধান নই। আমি সেখানকার কনসালটেন্ট। আমার নেতৃত্বে একদিনে এতো এন্ডোসকপি হওয়ার সুযোগ নেই। হতে পারে আমিসহ সবাই মিলে এতগুলো করেছেন ওই দিনে”।
তিনি বলেন, “এন্ডোসকপি রুম হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ তদারক করে। তবে আমাদের এখানে এসব বিষয়ে কোন প্রফেশনাল বডি বা রেগুলেটরি সংস্থার কোন গাইডলাইন নাই। বিশেষজ্ঞরা নিজের অভিজ্ঞতা ও বিবেচনা প্রয়োগ করে রোগীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে কাজগুলো করে থাকেন”।
এন্ডোসকপি বা এ ধরণের কাজগুলো করার আগে সব নিয়ম কানুন কতটা মানা হয় এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “ল্যাবএইডে প্রয়োজনীয় সব উপকরণ আছে। আমি আমার ক্ষেত্রে প্রতিটি রোগীর ইসিজি ও ইকোসহ প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করিয়ে নেই। ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে নরমাল এন্ডোসকপি করি। অর্থসংকটে পড়লে অনেক রোগীকে আমি ল্যাবএইড থেকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি”।
ল্যাবএইড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এ এম শামীম বলছেন সার্জারি এন্ডোসকপির মতো বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একজন চিকিৎসক যে প্রটোকল বা প্রসিডিউর অনুসরণ করেন তার হাসপাতালেও তাই করা হচ্ছে।
“তবে কর্তৃপক্ষ যদি কোন রেগুলেটরি বডি বা এক্রিডিটেশন কাউন্সিল করে তারা হয়তো সবার জন্য বলে দিতে পারতো যে একজন চিকিৎসক কতটা সময় দিবেন রোগীকে, কোন ক্ষেত্রে কি কি নিয়ম কানুন অনুসরণ করতেই হবে, না করলে কী হবে – তা হলে সরকারি বেসরকারি সব হাসপাতালেরই ব্যবস্থাপনা সহজ হতো এবং রোগীরা বেশী উপকৃত হতো এবং একই সাথে এসব বিষয়ে আর বিতর্ক হতো না”।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাঃ মুশতাক হোসেন বলছেন সক্ষমতা ও লোকবল থাকলে একটি হাসপাতাল যত খুশী সার্জারি বা এন্ডোসকপির মতো কাজগুলো করতে পারে।
“অনেক ডাক্তার, টেকনিশিয়ান ও উপকরণ থাকলে অসুবিধা নেই। কিন্তু কোয়ালিটি কন্ট্রোল হয় কি-না সেটি মনিটরিংয় নিশ্চিত করা জরুরি। একটা এন্ডোসকপির আগে রোগীর প্রস্তুতি, ইনফেকশন কন্ট্রোল, চিকিৎসকের প্রস্তুতি ও ফলো আপ করার ব্যবস্থা -সব কিছু নিশ্চিত করতে হবে,” বলছিলেন তিনি।